ভালোলাগা কবিতা

প্রতিমা
-হেলাল হাফিজ


     প্রেমের প্রতিমা তুমি, প্রণয়ের তীর্থ আমার
     বেদনার করুন কৈশোর থেকে তোমাকে সাজাবো বলে
     ভেঙেছি নিজেকে কী যে তুমুল উল্লাসে অবিরাম
     তুমি তার কিছু কি দেখেছো?

     
     একদিন এই পথে নির্লোভ ভ্রমণে
     মৌলিক নির্মান চেয়ে কী ব্যাকুল স্থপতি ছিলাম,
     কেন কালিমা না ছুঁয়ে শুধু তোমাকে ছুঁলাম
     ওসবের কতোটা জেনেছো?
   
     শুনেছি সুখেই বেশ আছো। কিছু ভাঙচুর আর
     তোলপাড় নিয়ে আজ আমিও সচ্ছল, টলমল
     অনেক কষ্টের দামে জীবন গিয়েছে জেনে
     মূলতই ভালোবাসা মিলনে মলিন হয়, বিরহে ‍উজ্জ্বল।


     এ আমার মোহ বলো, খেলা বলো
     অবৈধ মুদ্রার মতো অচল আকাঙ্খা কিংবা
     যা খুশী তা বলো,
     সে আমার সোনালি গৌরব
     নারী, সে আমার অনুপম প্রেম।

     তুমি জানো,পাড়া-প্রতিকবেশী জানে পাইনি তোমাকে,

     অথচ রয়েছো তুমি এই কবি সন্ন্যাসীর ভোগে আর ত্যাগে।

-----------------------------------------------

আমার বন্ধু নিরঞ্জন  -ভাস্কর চৌধুরী

অনেক কথা বলবার আছে আমার
তবে সবার আগে নিরঞ্জনের কথা বলতে হবে আমাকে
নিরঞ্জন আমার বন্ধুর নাম, আর কোন নাম ছিল কি তার ?
আমি জানতাম না।

ওর একজন বান্ধবী ছিল অবশ্য কিছু দিনের জন্য
সে তাকে প্রীতম বলে ডাকত।
ওর বান্ধবীর নাম ছিল জয়লতা
নিরঞ্জন জয়লতা সম্পর্কে আমাকে কিছু বলেনি তেমন।
জয়লতাকে কখনো কোন চিঠি লিখেছিল কিনা
সে কথাও আমাকে সে বলেনি।
তবে জয়লতার চিঠি আমি দেখেছি
একটা চিঠি ছিল এরকম-
প্রীতম,
সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। তুমি বলেছ, এখন দুঃসময়-
কিন্তু আমি জানি, সবসময়ই সুসময়, যদি কেউ ব্যবহার করতে জানে তাকে
আমি বুঝি বেশী দিন নেই যদি পার এক্ষুনি তুলে নাও
নইলে অন্য পুরুষ ছিবড়ে খাবে আমাকে-
আমার ঘরে, বসে সিগারেট টানতে টানতে
নিরঞ্জন চিঠিটা চুপ করে এগিয়ে দিয়ে বলেছিল, বিভূ, চিঠিটা পড়ুন।
আমি প্রথমে পড়তে চাইনি।
পরে ওইটুকু পড়ে তার দিকে তাকিয়েছিলাম-
না-ওই সিগারেটের ধূয়োয়
আমি কোন নারী প্রেম-তাড়িত মানুষের ছায়া দেখিনি- ভয়ানক নির্বিকার।
কিছু বলছেন না যে ? আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম
কি বলবো ? এই ব্যাপারে।
কোন ব্যাপারে ?
এই যে জয়লতা।
বাদ দিন।
আমি বাদ দিয়েছিলাম।
নিরঞ্জন আমার ঘরে বসে অনেকক্ষণ সিগারেট
টেনে টেনে ঘরটাকে অন্ধকার করে চলে গিয়েছিল সেদিন।
জয়লতার সঙ্গে অন্য পুরুষের বিয়ে হয়েছিল
আমি জয়লতা এবং অন্য পুরুষটিকে দেখেছি বহুবার, বিশ্ববিদ্যালয়েই। জয়লতা আরো দেমাগী
আরো সুন্দরী হয়ে উঠেছিল।
অন্য পুরুষ ছিবড়ে খেলে মেয়েরা বুঝি
আরো সুন্দরী হতে থাকে ?

এ কথার সূত্রে সেদিন নিরঞ্জন আমাকে বলেছিল,
মানুষকে এত ক্ষুদ্রার্থে নেবেন না,
মানুষ এত বড় যে,
আপনি যদি ‘মানুষ’ শব্দটি
একবার উচ্চারণ করেন
যদি অন্তর থেকে করেন উচ্চারণ
যদি বোঝেন এবং উচ্চারণ করেন ‘মানুষ’
তো আপনি কাঁদবেন।
আমি মানুষের পক্ষে,
মানুষের সঙ্গে এবং মানুষের জন্যে।

হ্যাঁ, মানুষের মুক্তির জন্য
নিরঞ্জন মিছিল করতো।
আমি শুনেছি নিরঞ্জন বলছে...
তুমি দুস্কৃতি মারো, গেরিলা-তামিল মারো
এভাবে যেখানে যাকেই মারো না কেন
ইতিহাস লিখবে যে এত মানুষ মরেছে
বড়ই করুণ এবং বড়ই দুঃখজনক
শক্তির স্বপ্নে তুমি যারই মৃত্যু উল্লেখ করে
উল্লাস করনা কেন
মনে রেখো মানুষই মরেছে
এই ভয়ঙ্কর সত্য কথা নিরঞ্জন বলেছিল
মিছিলে হাত উঠিয়ে বলেছিল,
এভাবে মানুষ মারা চলবে না।
মানুষকে বাঁচতে দাও।
নিরঞ্জন আমার বন্ধু।
নিরঞ্জন বাঁচেনি।
তার উদ্যত হাতে লেগেছিল
মানুষের হাতে বানানো বন্দুকের গুলি।
বুকেও লেগেছিল- যেখান থেকে ‘মানুষ’ শব্দটি
বড় পবিত্রতায় বেরিয়ে আসতো।
সে লাশ-
আমার বন্ধু নিরঞ্জনের লাশ,
আমি দেখেছি
রক্তাক্ত ছিন্ন ভিন্ন লাশ,
মানুষ কাঁধে করে
তাকে বয়ে এনেছিল মানুষের কাছে।
জয়লতা সে লাশ দেখেছিল কিনা
সে প্রশ্ন উঠছে না।
দেখলেও যদি কেঁদে থাকে
সে প্রকাশ্যে অথবা গোপনে
তাতে নিরঞ্জনের কোন লাভ হয়নি।
মানুষ কেঁদেছিল
আমি জানি তাতে নিরঞ্জনের লাভ ছিল।
নিরঞ্জন প্রমাণ করতে পেরেছিল
গতকাল মিছিলে
আইন অমান্যের অভিযোগে
যে দুস্কৃতি মারা গিয়েছে
তার নাম নিরঞ্জন-
সে আসলে ‘মানুষ।’
............................................................................................
কথোপকথন  -পুর্ণেন্দু পত্রী

- কি করছো?
- ছবি আকঁছি।
- ওটা তো একটা বিন্দু।
-তুমি ছুঁয়ে দিলেই বৃত্ত হবে। কেন্দ্র হবে তুমি। আর আমি হবো বৃত্তাবর্ত।
- কিন্তু আমি যে বৃত্তে আবদ্ধ হতে চাই না। আমি চাই অসীমের অধিকার।
- একটু অপেক্ষা করো। . . . এবার দেখো।
- ওটা কি? ওটা তো মেঘ।
- তুমি ছুঁয়ে দিলেই আকাশ হবে। তুমি হবে নি:সীম দিগন্ত। আর আমি হবো দিগন্তরেখা।
- কিন্তু সে তো অন্ধকার হলেই মিলিয়ে যাবে। আমি চিরন্তন হতে চাই।
- আচ্ছা, এবার দেখো।
- একি! এ তো জল।
- তুমি ছুঁয়ে দিলেই সাগর হবে। তিনভাগ জলের তুমি হবে জলকন্যা। আর আমি হবো জলাধার।
- আমার যে খন্ডিতে বিশ্বাস নেই। আমার দাবী সমগ্রের।
- একটু অপেক্ষা করো। এবার চোখ খোল।
- ওটা কি আঁকলে? ওটা তো একটা হৃদয়।
- হ্যাঁ, এটা হৃদয়। যেখানে তুমি আছো অসীম মমতায়, চিরন্তন ভালোবাসায়। এবার বলো আর কি চাই তোমার?
- সারাজীবন শুধু ওখানেই থাকতে চাই।
..............................................................................................................................


সেই গল্পটা     -পূর্ণেন্দু পত্রী 
আমার সেই গল্পটা এখনো শেষ হয়নি।
শোনো।
পাহাড়টা, আগেই বলেছি
ভালোবেসেছিলো মেঘকে
আর মেঘ কি ভাবে শুকনো খটখটে পাহাড়টাকে
বানিয়ে তুলেছিল ছাব্বিশ বছরের ছোকরা
সে তো আগেই শুনেছো।
সেদিন ছিলো পাহাড়টার জন্মদিন।
পাহাড় মেঘকে বললে
– আজ তুমি লাল শাড়ি পরে আসবে।
মেঘ পাহাড়কে বললে
– আজ তোমাকে স্নান করিয়ে দেবো চন্দন জলে।
ভালোবাসলে নারীরা হয়ে যায় নরম নদী
পুরুষেরা জ্বলন্ত কাঠ।
সেইভাবেই মেঘ ছিল পাহাড়ের আলিঙ্গনের আগুনে
পাহাড় ছিলো মেঘের ঢেউ-জলে।
হঠাৎ,
আকাশ জুড়ে বেজে উঠলো ঝড়ের জগঝম্প
ঝাঁকড়া চুল উড়িয়ে ছিনতাই এর ভঙ্গিতে ছুটে এল
এক ঝাঁক হাওয়া
মেঘের আঁচলে টান মেরে বললে
– ওঠ্‌ ছুঁড়ি! তোর বিয়ে ।
এখনো শেষ হয়নি গল্পটা।
বজ্রের সঙ্গে মেঘের বিয়েটা হয়ে গেলো ঠিকই
কিন্তু পাহাড়কে সে কোনোদিন ভুলতে পারলনা।
বিশ্বাস না হয় তো চিরে দেখতে পারো
পাহাড়টার হাড়-পাঁজর,
ভিতরে থৈথৈ করছে
শত ঝর্ণার জল।
.............................................................................

লবণ    -আদিত্য অনীক

বই মেলায়, থিয়েটারে, ক্যাফেটেরিয়ায়, পহেলা বৈশাখে, ভ্যালেন্টাইন উতসবে
শুধু মেয়েটার চোখে পড়ার দুঃসহ চেষ্টা ছাড়া ছেলেটা পুরাদস্তুর সাধারণ
মেয়েটা রূপে ও লাবণ্যে ফ্যাসনে ও বসনে আগাগোড়া বিশেষণ।
এক ঝাঁক প্রজাপতি উচ্ছল তরুণের ভিড়ে ছেলেটা একেবারে অপাঙ্ তেয়
তবু অতি বড়ো সাহস করে একদিন বলেই ফেলল, আমার সাথে চা খাবে?
ছেলেটার দুঃসাহসী অফারে অবাক মেয়েটা কী জানি কি মনে করে বলল, চল।
মেয়েটার মুখোমুখি বসা ছেলেটার বুক ধড়ফড়, আড়ষ্ট জিহ্বা, চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, ওয়েটার আমাকে লবণ দাও।
মেয়েটা অবাক হয়ে বলল, তুমি চায়ে লবণ খাবে নাকি?
ছেলেটা বলল, হ্যাঁ, আমার জন্ম নোনা জলের সাগর পারে,
নোনা চায়ে চুমুক দিলে আমার চোখে ভেসে ওঠে আমার গ্রাম, নোনা জলে ভেসে যাওয়া আমার বাবা মায়ের মুখ।
মেয়েটা অবাক হয়ে শুনলো ছেলেটার কথা, তারপর বলল,
আমি কোনোদিন সাগর দেখিনি, আমার বাড়ি পাহাড়ে,
ওখানে গা ছুঁয়ে উড়ে যায় কোমল মেঘ পাখির মতো।
সাগর আর পাহাড়ের গল্প ক্রমেই নিবিড় হলো দিনে দিনে।
তারপর বিয়ে সংসার এবং শেষে বুড়ো ও বুড়ি।
বুড়ো মরার আগে বুড়ির হাতে একটা চিঠি দিয়ে বলল, মরার পর খুলবে।
বুড়ো মারা যাওয়ার পর বুড়িটা চিঠিটা খুলল, তাতে লেখা আছে,
লবণ দিয়ে চা আমি কখনোই খেতাম না, তোমার সামনে থতমত খেয়ে চিনি বলতে লবণ বলে ফেলেছিলাম।
আর বোকামি ঢাকতে অমন গল্প ফেঁদেছিলাম। তাই চল্লিশ বছর তোমার হাতে লবণ চা খেয়ে গেলাম।
তোমার হাতের লবণ-চা খুব মিষ্টি।
বুড়ি প্রতিবেশীর বাড়িতে বেড়াতে গেলো একদিন। তাকে চা দেয়া হলো।
বুড়ি বলল, একটু লবণ দিন।
অবাক হয়ে প্রতিবেশী বলল, আপনি লবণ দিয়ে চা খাবেন নাকি?
বুড়ি বলল, হ্যাঁ, লবণ-চা খুব মিষ্টি।
বিঃদ্রঃ কালি ও কলম পত্রিকায় (চতুর্থ বর্ষ:ষষ্ঠ সংখ্যা: শ্রাবণ ১৪১৪) এ কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছে।
.....................................................................................

মাধবীর জন্যে - পূর্ণেন্দু পত্রী

আয়নার পাশে একটু অন্ধকার ছায়া এঁকে দাও।
ব্যথিত দৃশ্যের পট জুড়ে থাক চিত্রিত আঁধার।
দেয়ালের ছবিটাকে একটু সরাতে হবে ভাই।
ওটা নয়, এই ছবিটাকে।
জুলিয়েট জ্যেৎস্নার ভিতরে
রক্তে উচ্চকিত তৃষ্ণা রোমিওর উষ্ণ ওষ্ঠাধরে।
ব্যাস, ব্যাস।
লাইটস্ বার্ণিং।
মাধবী, আসুন।
একটা ক্লোজআপ নেব।
এখানে দাঁড়ান, একটু বা দিক ঘেষে প্লীজ।
মনিটার…
মাধবী বলুন-
কিছু লাভ আছে মনে রেখে?
না। অত স্পষ্ট নয়।
আরেকটু নির্জন স্বরে
নিজের আত্মার সঙ্গে কথোপকথন।
যেন মনে হয়
ওষ্ঠ হতে উচ্চারিত কয়েকটি শীতল বাক্য নয়।
মনে হবে সন্ধ্যাবেলা সারা ধরাতলে
অবসন্ন কুসুমের ঝরিতেছে বনবীথিতলে নীরব রোদনে।

মনে হবে নীরব বোদনে
যেন আপনি বলতে চান
মনে রেখো, মনে রেখা সখা,
যেন কেহ কোনোদিন মনে রাখে নাই
মনে আর রাখিবে না।
জ্যেৎস্নার ভিতরে কোথাও আহ্বান নেই আর,
উষ্ণ ওষ্ঠাধর দুটি গোলাপের মহিমায় ফুটে
এখন অপেক্ষমান
কবে পাখি বলে যাবে, রাত্রি হলো অবসান বনবীথিতলে।
দৃষ্টি আরও নত হবে
সম্মূখে কোথাও কোনো দেখিবার মতো দৃশ্য নাই।
নিবন্ত ধূপের সাদা ছাই
রজনী পোয়ানো কিছু মৃত গোলাপের দীর্ঘশ্বাস
হাঁ-করা নেকড়ের মুখে দগ্ধ সিগারেট
এইটুকু দৃশ্যে শুধু পড়ে আছে কাঠের টেবিলে।
লাইটস্ বার্ণিং।
মাধবী, মেক-আপ্, আলো,
এবার টেকিং
মাধবী, নিশ্চয় মনে আছে সংক্ষিপ্ত সংলাপটুকু
কিছু লাভ আছে মনে রেখে?
................................................................................

শুধু তোমার জন্য  -নির্মলেন্দু গুণ -নির্মলেন্দু গুণ
কতবার যে আমি তোমোকে স্পর্শ করতে গিয়ে
গুটিয়ে নিয়েছি হাত-সে কথা ঈশ্বর জানেন।
তোমাকে ভালোবাসার কথা বলতে গিয়েও
কতবার যে আমি সে কথা বলিনি
সে কথা আমার ঈশ্বর জানেন।
তোমার হাতের মৃদু কড়ানাড়ার শব্দ শুনে জেগে উঠবার জন্য
দরোজার সঙ্গে চুম্বকের মতো আমি গেঁথে রেখেছিলাম
আমার কর্ণযুগল; তুমি এসে আমাকে ডেকে বলবেঃ
‘এই ওঠো,
আমি, আ…মি…।'
আর অমি এ-কী শুনলাম
এমত উল্লাসে নিজেকে নিক্ষেপ করবো তোমার উদ্দেশ্যে
কতবার যে এরকম একটি দৃশ্যের কথা আমি মনে মনে
কল্পনা করেছি, সে-কথা আমার ঈশ্বর জানেন।
আমার চুল পেকেছে তোমার জন্য,
আমার গায়ে জ্বর এসেছে তোমার জন্য,
আমার ঈশ্বর জানেন- আমার মৃত্যু হবে তোমার জন্য।
তারপর অনেকদিন পর একদিন তুমিও জানবে,
আমি জন্মেছিলাম তোমার জন্য। শুধু তোমার জন্য।
.....................................................................
যাত্রা-ভঙ্গ        -নির্মলেন্দু গুণ
হাত বাড়িয়ে ছুঁই না তোকে,
মন বাড়িয়ে ছুঁই,
দুইকে আমি এক করি না
এক কে করি দুই৷
হেমের মাঝে শুই না যবে,
প্রেমের মাঝে শুই
তুই কেমন করে যাবি?
পা বাড়ালেই পায়ের ছায়া
আমাকেই তুই পাবি৷
তবুও তুই বলিস যদি যাই,
দেখবি তোর সমুখে পথ নাই৷
তখন আমি একটু ছোঁব,
হাত বাড়িয়ে জাড়াব তোর
বিদায় দুটি পায়ে,
তুই উঠবি আমার নায়ে,
আমার বৈতরনী নায়ে৷
নায়ের মাঝে বসব বটে,
না-এর মাঝে শোব৷
হাত দিয়েতো ছোঁব না মুখ,
দু:খ দিয়ে ছোঁব৷
তুই কেমন করে যাবি?
.................................................................
মা, এবারের শীতে       -তসলিমা নাসরিন
শীত আসছে, উঠোনে শীতলপাটি বিছিয়ে এখন লেপ রোদে দেবার সময়।
মা আমার লেপ-কম্বল রোদে দিচ্ছেন, ওশার লাগাচ্ছেন, কোলবালিশে তুলো
ভরছেন - উঠোনে তুলো ধুনছে ধুনরিরা...
শীত এলেই মা'র এমন দম না ফেলা ছুটোছুটি শুরু হয়ে যায়।
এবারের শীতেও রোদে শুকোনো লেপ এনে বিছানায় গুছিয়ে রেখেছেন মা।
এবারের শীতেও আচারের বয়াম রোদে দিচ্ছেন,
এবারের শীতেও ভাপা পিঠে বানাবার হাঁড়ি ন্যাকড়া জোগাড় করছেন।
কার জন্য? কে আছে বাড়িতে যে কিনা সারা শীত লেপের তলায় গুটি মেরে, মনে
মনে চমৎকার চাঁদের আলোয়, অরণ্যে, কাঠখড় কুড়িয়ে আগুন তাপায়, আমি
ছাড়া!
কে আছে বাড়িতে যার জন্য মিনিট পর পর ধোঁয়া ওঠা চা, মুড়ি ভাজা, আর
দুপুর হতেই আম বা জলপাইয়ের আচার-
ভোরের খেজুর-রস আর পিঠেপুলি- কার জন্য!
এবারের শীতে আমি স্ক্যানডেনেভিয়ায়, বরফে আর অন্ধকারে ডুবে আছি
জানি, ফেরা হবে না আমার, মাও তো জানেন ফেরা হবে না, রোদ পড়া উঠোন
আর নকশি কাঁথায় ন্যাপথলিনের ঘ্রাণের ওপর পাশের বাড়ির বেড়াল এসে শোবে

এত জেনেও মা কেন রোদে দিচ্ছেন আমার কাঁথা-কাপড়, লেপ, কার্পাস তুলোর
বালিশ!
এত জেনেও মা কেন ডুকরে কেঁদে ওঠেন ফোনে, যখন আমি পৃথিবীর শেষ প্রান্ত
থেকে সুখবর দিই- 'ভাল আছি'।
অবুঝ আমার মা, আঙুলের কড়ায় গোনেন দিন, বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকেন
অপেক্ষায়। আর আচমকা প্রশ্ন করেন 'কখন আসছ তুমি? তুমি তো ঘুমোবে
এখানে, তোমার বিছানায়, গল্প শুনতে শুনতে নন্দীবাড়ির ভূতের আর বনের কাঠুরের আর
ব্যাং রাজকুমারের আর...
মা কি আগামী শীতেও আমার জন্য আবার রোদে দেবেন লেপ-তোশক, আচারের
বয়াম,
আর দরজায় টোকা পড়লে বঁটিতে মাছ রেখেই দৌড়ে দেখবেন আমি কি না!
..............................................................................................

ভালবাসার গল্প   -- আদিত্য অনীক

রাখ্ তোর মেয়ে পটানো কবিতা,তুই
হবি রাম আমি হব সীতা
এদিকে আয়,আমার কথায় মন দে,সূর্য
ডুবে যখন নামবে সন্ধ্যে,
তখন আসবি পুকুড় পাড়ে খঁড়ের গাদার
পাশে
বুঝিয়ে দেব দাদা-বউদি কেমনে ভালবাসে ।
পথে যদি ঝিঙে ফুল পাস্
তবে সঙ্গে করে আনিস
পিছন থেকে ঝাপটে ধরে খোঁপায় গেঁথে দিস্।
লক্ষীর সাথে ভাব মারিস ?বাসিস
নাকি ভালো ?
তার চে' আমি কম কিসে রে ? না হয় একটু
কালো ।
দেখ না আমার শরীরটা- তুলার মত নরম
ছোঁসনে এখন,কাতুকুতু লাগেতো ।বন্ধ
হবে দম ।
সন্ধ্যে বেলা আসবি যখন তখন
ছুঁয়ে দেখিস্
ছোঁয়ার নামে দেখিস আবার থেঁতলে যেন
না দিস্
কালী সন্ধ্যায় খড়ের গাদা আঁধার
হয়ে আছে

পা টিপে আস্তে আস্তে গেলাম
আরো কাছে ।
ভাবলাম গাদার
গায়ে সীতা বুঝি গুহা করেছে
গুহার মধ্যে বিড় পাকিয়ে ওম জমিয়েছে ।
ও সীতা দেখ্, ঝিঙ্গে ফুলের গোছা এনেছি
ফিসফিসিয়ে বলে যেমনি হাত বাড়িয়েছি ,
অমনি কুকুর যমের মত ঘড়র ঘড়র করে
হঠাত্ এসে ঝাপিয়ে পড়লো কচি ঘাড়ের
পরে ।
কালো কুত্তা খাইলো বুঝি ওরে মা'রে বাপ
হুড়মুড়িয়ে দৌড়ে সোজা পুকুর জলে ঝাপ ।
বাবা বললো,গলা ছেড়ে জলে নামল
কে রে ?
কেমনে বলি তোমার ছেলে পড়ছে সীতার
ফেরে ।
বাড়ির কুকুর কয়লামতি গর্ত করে খড়ে
বিকেল বেলা ছা দিয়েছে জানবো কেমন
করে ???    
....................................................................... 

সহজ   -জীবনানন্দ দাশ


আমার এ গান
কোনোদিন শুনিবে না তুমি এসে–
আজ রাত্রে আমার আহ্বান
ভেসে যাবে পথের বাতাসে–
তবুও হৃদয়ে গান আসে!
ডাকিবার ভাষা
তবুও ভুলি না আমি–
তবু ভালোবাসা
জেগে থাকে প্রাণে!
পৃথিবীর কানে
নক্ষত্রের কানে
তবু গাই গান!
কোনোদিন শুনিবে না তুমি তাহা, জানি আমি–
আজ রাত্রে আমার আহ্বান
ভেসে যাবে পথের বাতাসে–
তবুও হৃদয়ে গান আসে!
তুমি জল, তুমি ঢেউ, সমুদ্রের ঢেউয়ের মতন
তোমার হেদের বেগ– তোমার সহজ মন
ভেসে যায় সাগরের জলে আবেগে!
কোন্‌ ঢেউ তার বুকে গিয়েছিল লেগে
কোন্‌ অন্ধকারে
জানে না সে!– কোন ঢেউ তারে
অন্ধকারে খুজিছে কেবল
জানে না সে! রাত্রির সিন্ধুর জল,
রাত্রির সিন্ধুর ঢেউ
তুমি একা! তোমারে কে ভালোবাসে! — তোমারে কি কেউ
বুকে করে রাখে!
জলের আবেগে তুমি চলে যাও —
জলের উচ্ছ্বাসে পিছে ধু ধু জল তোমারে যে ডাকে!
তুমি শুধু এক দিন — এক রজনীর!–
মানুষের মানুষীর ভিড়
তোমারে ডাকিয়া লয় দূরে — কত দূরে!
কোন্‌ সমুদ্রের পারে — বনে — মাঠে — কিংবা যে আকাশ জুড়ে
উল্কার আলেয়া শুধু ভাসে! —
কিংবা যে আকাশে
কাস্তের মতো বাঁকা চাঁদ
জেগে ওঠে, ডুবে যায় — তোমার প্রাণের সাধ
তাহাদের তরে!
যেখানে গাছের শাখা নড়ে
শীত রাতে — মড়ার হাতের শাদা হাড়ের মতন! —
যেইখানে বন
আদিম রাত্রির ঘ্রাণ
বুকে লয়ে অন্ধকারে গাহিতেছে গান!–
তুমি সেইখানে!
নিঃসঙ্গ বুকের গানে
নিশীথের বাতাসের মতো
একদিন এসেছিলে —
দিয়েছিলে এক রাত্রি দিতে পারে যত!
 

No comments: